ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ০৫/০৩/২০২৫ ১০:৩২ এএম , আপডেট: ০৫/০৩/২০২৫ ১:১৯ পিএম
ত্রাণের লোভে নাম লিখিয়ে উল্টো বাস্তুচ্যুত হওয়ার শঙ্কা রোহিঙ্গা পরিচয়পত্র হাতে স্থানীয় বাংলাদেশি নারী রহিমা বেগম

তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজার

কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা রহিমা বেগম (৪৫)। ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা ঢলের সময় তাঁর পরিবারের ১২ জন ত্রাণের লোভে ছবিসহ আঙুলের ছাপ দিয়ে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা তালিকায় নাম লেখায়। রোহিঙ্গাদের ছদ্মাবরণে এত দিন ত্রাণ সুবিধা ভোগ করলেও বিপত্তি ঘটেছে এখন। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু হলে তালিকায় নাম লেখানো সবাইকে মায়ানমারের রাখাইনে চলে যেতে হতে পারে।

কিংবা নেওয়া হতে পারে ভাসানচরের রোহিঙ্গাশিবিরে।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন খোকনের বাড়ির উঠানে গিয়ে দেখা যায়, অন্তত ৫০ থেকে ৬০ জন নারীর জটলা। তাঁদেরই একজন রহিমা। ত্রাণের লোভে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা হিসেবে নাম লিখিয়ে এখন উল্টো বাস্তুচ্যুত হওয়ার শঙ্কায় আছেন তাঁরা।

ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে এসেছেন আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার সহায়তা চাইতে। এ সময় স্থানীয় নারী ইউপি সদস্য (মেম্বার) জহুরা বেগমও সেখানে ছিলেন।
রহিমার ভাষ্য, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ঢলের সময় বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর বাজার এলাকায় একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প (নম্বর-২৩) স্থাপিত হয়। ক্যাম্পের রোহিঙ্গা শেড মাঝিদের সহযোগিতায় আরো স্থানীয়দের সঙ্গে তিনিও (রহিমা) বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের তালিকায় নাম লেখান।

তিনি একা নন, ছোট বোন খোরশেদাসহ তাঁর আরো এক ভাইয়ের সন্তান-সন্ততি মিলে একেবারে পরিবারের ১২ জন সদস্য রোহিঙ্গা তালিকায় নাম ওঠায়।
তিন বছর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পটি সেখানে ছিল। রহিমার পরিবার তত দিন পর্যন্ত মায়ানমার থেকে আশ্রয় নিতে আসা রোহিঙ্গাদের সমপরিমাণ ত্রাণসামগ্রী ভোগ করেছে। রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পটি সেখান থেকে সরিয়ে ভাসানচরসহ উখিয়া-টেকনাফের অন্যান্য ক্যাম্পে নেওয়া হয়। এ সময় ক্যাম্পের রোহিঙ্গা শেড মাঝি ক্যাম্প ইনচার্জকে (সিআইসি) বুঝিয়ে দেওয়ার নামে তাদের রেশন ও মায়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিক হিসেবে দেওয়া কার্ডগুলো নিয়ে নেয়।

সেই থেকে ত্রাণ বন্ধ হয়ে গেছে। রহিমার পরিবারের সদস্যদের জন্য দেখা দিয়েছে বিভিন্ন সমস্যা।
বড় সন্তান আরাফাতের জন্য পাসপোর্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। যারা রোহিঙ্গা তালিকাভুক্ত হওয়ার সময় ছবিসহ আঙুলের ছাপ দিয়েছে, তাদের কেউই পাসপোর্ট করতে পারছে না।

রহিমা বলেন, ‘লোকজন বলছে, আমরা নাকি এ দেশে আর ভোটও দিতে পারব না। পাসপোর্ট থেকে শুরু করে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) আওতায় কোনো কাজই করা যাবে না। ভাসানচরে যেতে হবে। এমনকি শেষ পর্যন্ত মায়ানমারের রাখাইনেও যেতে হতে পারে।’

রুবাইদা আকতার নামের এক নারী জানান, তাঁর নাম পরিবর্তন করে রাখাইনের বাস্তুচ্যুত নারী হিসেবে নাম হয়েছে নূর ফাতিমা। ছেলের নাম করিমুল্লাহর বদলে হয়েছে নূরুল্লাহ। এভাবে রুবাইদার পরিবারের আটজন এই তালিকাভুক্ত হয়েছে।

রুবাইদা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝিদের প্ররোচনায় লোভে পড়ে তালিকাভুক্ত হয়েছিলাম। তখন বুঝিনি পরিণতি কী হবে। কিন্তু ছেলে করিমুল্লাহ যখন পাসপোর্ট অফিসে ছবিসহ আঙুলের ছাপ দিতে গিয়ে রোহিঙ্গা হিসেবে ধরা খায়, তখন থেকে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়।’

তিনি বলেন, ছেলে পাসপোর্ট করতে না পেরে চার মাস আগে নৌপথে দালালের হাত ধরে ছয় লাখ টাকা ব্যয়ে মালয়েশিয়া পাড়ি জমিয়েছেন।

এই ভুলের জন্য তিনি অনুতপ্ত। এখন যেকোনোভাবে তাদের রোহিঙ্গা তালিকা থেকে সবার নাম কাটাতে চান। তাই ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে ধরনা দিয়েছেন। ইউপি চেয়ারম্যানের উঠানে জড়ো হওয়া অন্য সব নারীরও একই কথা—ত্রাণের প্রলোভনে এ কাজ করেছেন।

কত বাংলাদেশি রোহিঙ্গা তালিকাভুক্ত : কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়া, ভাসানচরসহ ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাংলাদেশি কমবেশি অনেকে রোহিঙ্গা হিসেবে তালিকাভুক্ত। গতকাল কক্সবাজারের রোহিঙ্গা প্রশাসন থেকে কালের কণ্ঠকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে কত সংখ্যক বাংলাদেশি রয়েছেন, এর কোনো তথ্য নেই।

রোহিঙ্গা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, সর্বশেষ দুই মাস আগে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা প্রায় ৬৫ হাজার (স্থানীয়দের মতে এক লাখ) রোহিঙ্গা তালিকাভুক্ত করার সময়ও স্থানীয় অনেক বাংলাদেশি লাইনে দাঁড়িয়ে নাম লিখিয়েছে।

গতকাল উখিয়া ও টেকনাফে সরেজমিন ঘুরে স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেছে, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় সহস্রাধিক পরিবারের লোকজন তালিকাভুক্ত হয়েছে। প্রতি পরিবারে গড়ে চার-পাঁচজন সদস্য ধরলেও এ সংখ্যা কমপক্ষে ৪০ থেকে ৫০ হাজার। উপজেলা দুটির ছয়টি ইউনিয়ন যথাক্রমে টেকনাফের সদর, বাহারছড়া, হ্নীলা, হোয়াইক্যং এবং উখিয়ার পালংখালী ও রাজাপালং ইউনিয়নের আওতায় ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প রয়েছে। এসব ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যানদের সঙ্গে আলাপ করে এ তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশি রোহিঙ্গা নিয়ে প্রতিক্রিয়া : এত দিন বিষয়টি অনেকের অজানা ছিল। কিছু লোক জানলেও সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু সোমবারের কালের কণ্ঠে বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে স্থানীয়দের টনক নড়ে।

বাহারছড়া ইউপির সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্য জহুরা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেহেতু রোহিঙ্গাদের জন্য স্থানীয়রা জায়গাজমি দিয়ে সহযোগিতা করেছে, সেহেতু স্থানীয় দরিদ্র লোকদেরও ত্রাণের আওতায় আনা জরুরি ছিল। কিন্তু তাই বলে ত্রাণ নিতে বাংলাদেশিদের জাতীয়তা রোহিঙ্গা হতে হবে কেন?’

নেপথ্যে কারা : স্থানীয় বাংলাদেশি লোকজনকে রোহিঙ্গা বানিয়ে ত্রাণ দেওয়ার নেপথ্যেও রোহিঙ্গারা জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এলাকার ২৩ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের তারেক নামের একজন শেড মাঝির একটি সিন্ডিকেট ছিল। সেই সিন্ডিকেটের সব সদস্যও রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গাপাড়ায় গিয়ে স্থানীয় নারীদের সঙ্গে কৌশলে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে ত্রাণ নিতে উদ্বুদ্ধ করে।

রোহিঙ্গা শেড মাঝিরা তাদের প্রশিক্ষিত নারীদের ক্যাম্পের বাইরে বিভিন্ন পাড়ায় ঘরভাড়া করে রেখে স্থানীয় নারীদের প্ররোচিত করে আসছে। গ্রামীণ নারীদের নামে ত্রাণের কার্ড করিয়ে সেসব কার্ডের ত্রাণ মূলত বেশির ভাগই রোহিঙ্গা সিন্ডিকেট হাতিয়ে নেয়।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে রোহিঙ্গা নারী
: বাহারছড়ার এক নম্বর ওয়ার্ডের আছাড়বনিয়ায় মুজিব বর্ষের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ভাড়া করে থাকছেন বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী। অভিযোগ রয়েছে, এসব নারী ভুক্তভোগী নারীদের জাতীয়তা পরিবর্তনের মাধ্যমে ত্রাণ কার্ড নিতে সহায়তা করেছেন।

গতকাল দুপুরে আছাড়বনিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা গেছে, ১১টি ঘরের মধ্যে পাঁচটি ঘরই ভাড়া দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের ঘরগুলোর বরাদ্দপ্রাপ্ত রফিক নামের একজন নিজের তৈরি ঘরে বাস করেন। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর মাসিক দুই হাজার টাকায় রোহিঙ্গা নারী মনোয়ারাকে ভাড়া দিয়েছেন। একই স্থানে গোলবাহার, সাকেরা ও অপর দুই রোহিঙ্গা নারীও ঘর ভাড়া নিয়ে থাকছেন। এসব রোহিঙ্গা নারী স্থানীয় গ্রামীণ নারীদের ত্রাণ কার্ড নিতে প্ররোচিত করেন। তবে কার্ডের ত্রাণসামগ্রী মূলত রোহিঙ্গারাই ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন।

আরআরআরসির ভাষ্য : কক্সবাজারের রোহিঙ্গা প্রশাসনের প্রধান কর্মকর্তা, রোহিঙ্গা ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) এবং সরকারের অতিরিক্ত সচিব মো. মিজানুর রহমান গতকাল সন্ধ্যায় এসব বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন. ‘সোমবার কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি সঠিক। প্রচুরসংখ্যক স্থানীয় বাংলাদেশি ত্রাণের লোভে হোক বা অন্য কোনো কারণে হোক, রোহিঙ্গা তালিকাভুক্ত হয়ে এখন সমস্যায় পড়েছেন। আমি ভুক্তভোগীদের আবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠিয়েছি। এগুলো যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশি প্রমাণিত হলে এসব জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক হাইকমিশন—ইউএনএইচসিআরের অফিসে পাঠানো হবে। তারা যথারীতি নাম কর্তন করে দেবে।’ তিনি বলেন, ‘তালিকাভুক্ত স্থানীয় অনেককে এর মধ্যে ভাসানচরে পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।’ সুত্র, কালেরকন্ঠ

পাঠকের মতামত

জাগো নিউজের প্রতিবেদন পার্বত্যাঞ্চল-কক্সবাজার ঘিরে আরাকান আর্মির ‘নীল নকশা’

কক্সবাজারের টেকনাফের নাফ নদীতে মাছ শিকার করা জেলেদের অপহরণ মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির জন্য ...

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় দুর্বৃত্তের গুলিতে জামায়াতের ২ কর্মী নিহত

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় দুর্বৃত্তের গুলিতে জামায়াতের দুই কর্মী নিহত হয়েছেন। গতকাল সোমবার রাত ১০টার দিকে উপজেলার ...